ধূমকেতু যেন গণমানুষের কথা বলে
‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুণ মহাবিপ্লব হেতু এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!’- এমন বিপ্লবী উচ্চারণ দিয়েই শুরু কাজী নজরুল ইসলামের ‘ধূমকেতু’ কবিতা। যে কবিতার প্রতিটি চরণে রয়েছে পরাধীনতা, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে আহুত বিপ্লব ও ধ্বংসের গর্জন। ‘আমি অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!’- তিনি দুর্নিবার এবং নতুন সৃষ্টির লক্ষেই করেন অনাসৃষ্টি। ‘তাই বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, ------’ তিনি বিদ্রোহ করেন ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।
আমি বিপ্লবী নই, তবে গড়পড়তাভাবে আমি একজন প্রতিবাদী। আমি বিপ্লব করিনা ভয়ে, আমি কাপুরুষ, অন্যায় দেখি, সহ্য করি- প্রতিবাদ সেটি আগে করলেও এখন নিশ্চুপ থাকি। আমি ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় যতটা পারি নিরন্তর যুদ্ধ করি- হারি কদাচিৎ। এখন আমি ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিনা। অন্যায় কিছু দেখলে নিজেকে গাঁ বাঁচিয়ে এড়িয়ে যাই। অথচ সেই আমি, অনেকটাই সত্য বলার একটা মাধ্যম ও হাতিয়ার হিসেবে খুলে ফেললাম মহাবিদ্রোহী নজরুলের কর্মফুল ‘ধূমকেতু’ নামে পত্রিকা। আশা রইল নজরুলের ধূমকেতু না হলেও আমাদের ধূমকেতু যেন গণমানুষের কথা বলে, দেশ-মাতৃকার কথা বলে, মহান স্বাধীনতার কথা বলে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা বলে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতিয়তাবাদের কথা বলে, ৩০ লক্ষ শহীদ ও আড়াই লক্ষ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের অবর্ণনীয় বিভীষিকাময় যন্ত্রণাকাতর রক্তক্ষরণের কথা বলে, ফুটপাতে শুয়ে থাকা ও কাওরান বাজারে মুটে-মজুরের ঝুড়িতে বাঁকা হয়ে ঘুমানো অবহেলিত না খাওয়া ক্ষীণকায় শিশু কিশোরের বঞ্চনা ও দুর্দশার কথা বলে; সে সব হায়েনা ও হারামীর বিরুদ্ধে কথা বলে যারা মানবতাকে পদদলিত করে, যারা শোষিত ও বঞ্চিতদের জীর্ণ ও মানবেতর জীবনে নিক্ষেপ করে, যারা বেশ্যার দালালী করে; ধূমকেতু যেন সেই অপরাজনীতির প্রতিবাদ করে যারা মানুষের সকল মৌলিক অধিকার হরণ করে, আমাদের বাঙালিত্ব ও অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে; এবং সেই আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে যারা সেবার পরিবর্তে প্রভু সেজে মানবতাকে ভুলুন্ঠিত করে।
আসলে ধূমকেতু একটি মহাজাগতিক বস্তু। বিগব্যাং থিওরি মতে অতি ক্ষুদ্র এক কণা বিস্ফোরিত হয়ে ফিশন ও ফিউশনের মাধ্যমে পরমাণু ও অনু এবং তদপরবর্তী কালে পদার্থের সৃষ্টি হয়- যা প্রথমে গ্যাসীয়, পরে তরল ও কঠিন পদার্থে রূপ পরিগ্রহ করে। সম্প্রসারিত সেই বেলুনাকার বস্তুই আজকের মহাবিশ্ব যা সকল মহাজাগতিক কণা, ধূলি, ধূয়া, বাষ্প ও কঠিন পদার্থসহ অগনিত গ্রহ, উপগ্রহ ও নক্ষত্রকে ধারণ করে রেখেছে। যার মধ্যে ধুমকেতু বা কমেট এক শ্রেণীর মহাজাগতিক বস্তু। সাধারণত সৌর জগতের অর্থাৎ সূর্যকে কেন্দ্র করে গড়েওঠা জগতের গ্রহ ও উপগ্রহের অতিরিক্ত মহাজাগতিক দ্রব্যাদি একীভূত হয়ে এই ধূমকেতু গঠিত বলে ধারণা করা হয়। এটি বরফ, ধূলা ও ক্ষ্রদ্র ক্ষ্রদ্র পাথুরে কনার সমন্বয়ে গঠিত নানা আকারের হয়ে থাকে। তবে সাধারণভাবে এটি দেখতে খানিকটা গৃহাঙ্গিনার ধূলা-ময়লা পরিষ্কার করার ঝাঁটার ন্যায় একটি নিউক্লিয়াস ও পুচ্ছ বা লেজ বিশিষ্ট। এগুলোর প্রস্থ কয়েকশ’ মিটার থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়, যার লেজ কয়েকশ’ কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।উদাহরণ হিসেবে আমরা হ্যালির ধূমকেতুর কথা বলতে পারি। সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষ এমন আকারেই হ্যালির ধূমকেতু দেখে আসছেন।
এখন আসা যাক সমাজে ধুমকেতুর প্রভাব সম্পর্কে। আল বিরুনী রচিত ‘ভারত তত্ত্ব’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ধূমকেতুর আবির্ভাবকে ভারতীয়রা অমঙ্গলের ছায়া বা প্রতীক হিসেবে দেখে আসছে। অতি প্রাচীন কালে তারা মনে করত এটি আমাদের পূর্বজন্মের কর্মফল। পরবর্তীতে তারা মনে করে আসছে ধূমকেতু হচ্ছে, রাজার পাপের ফল। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাচীন কাল থেকে ধূমকেতুর এক বিরাট আনুচেতনিক পরিমন্ডল সৃষ্টি হয়ে আছে। ১৩০১ সালে হ্যালির ধূমকেতু দৃশ্যমান হয় এবং তার স্মরণে ১৩০৪ সালে Giotto Di Bonde কর্তৃক অঙ্কিত হয় হ্যালীর এ্যাডোরেশন অব ম্যাগী। তাঁরই স্মরণার্থে ১৯৮৬ সালে হ্যালীর ধূমকেতু পর্যবেক্ষণে মহাকাশ যান Giotto উৎক্ষেপণ করা হয়। ১৮১১ সালে লিও তলস্তয় তাঁর বিখ্যাত ওয়ার এন্ড পিচ বইয়ে ধূমকেতু সম্পর্কে উল্লেখ করেন। দীর্ঘ ১০০ বছর পর ১৯১০ সালে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধূমকেতু নিয়ে কবিতা লেখেন। তারও এক যুগ পর ১৯২২ সালে তিনি একক সম্পাদনায় ‘ধূমকেতু’ নামে প্রকাশ করেন একটি বাংলা অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা। ধূমকেতু পত্রিকাই প্রকাশ্যে নিয়ে আসে পরাধীনতা থেকে মুক্তির আহ্বানকে। কাজী নজরুল সৃষ্টি করেন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ছাপানো প্রতিবাদী এক দুর্বার আবহ। দিনে দিনে ধূমকেতু হয়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সংগ্রামরত তরুণ বিদ্রোহীদের মুথপত্র। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয় অন্যায় ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে লেখালেখির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বন্ধ হয়ে যায় গড়েওঠা প্রতিবাদী প্লাটফর্ম ধূমকেতু। আজ আরও এক শতাব্দি পরে ২০২৩ সালে আমি গুটি কয়েক তরুণকে নিয়ে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করছি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। সময়ের পরিসরে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এযুগে লোহার অক্ষরে ছাপানোর ক্লেশমুক্ত অনলাইন ভার্সন দিয়েই এ যাত্রা শুরু। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বলয় কর্তৃক লালনের মাত্রা ও আমার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে অদূর ভবিষ্যতে প্রিন্ট ভার্সন বের করার আশা রইল। আপনাদের সকলের সহযোগিতাই আমাদের অনুপ্রেরণা। ধূমকেতুর সাথেই থাকুন নতুন কোন সৃষ্টির আশায়।
লেখক: ড. প্রশান্ত কুমার রায়, সম্পাদক ও প্রকাশক, সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক