ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের দাবিতে ভারত আবারও দাঁড়াক বাংলাদেশের পাশে
বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত তার আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশি একটি দেশ হয়ে ভারতের কেন মাথাব্যথা থাকতে হবে? অবশ্যই এই প্রশ্নের উদ্রেক হতো না এবং ভারতকেও এই ইস্যুতে মাঠে নামতে হত না, যদি না বাংলাদেশের নির্বাচন এবং এ সংক্রান্ত বিষয়বাস্তবতা নির্ধারণ কেবল এ দেশের মানুষের ওপরই নির্ভর করত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। বিপরীতে এ দেশের বিরোধী দলগুলো বিদেশি শক্তিগুলো বিশেষকরে আমেরিকা ইউরোপের রাষ্ট্রদূতদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে, এবং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধিরাও বাংলাদেশের রাজনীতি ও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে খামখেয়ালী খেলায় মেতে উঠেছে। আর এই খেলার ফলাফল কী হতে পারে, কী হয়ে থাকে- এর অজস্র অন্ধকার অতীত নজির আছে। ভিশনারী রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে সমন্বিত উন্নয়নের পরিবর্তে পেছনপথে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের জাল সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এশিয়ার উদীয়মান ব্যাঘ্র বা উন্নয়নের বিস্ময় অভিধার বদলে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার লজ্জাকর পদক ঝোলে রক্তার্জিত বাংলাদেশের গলে। এমনকি সৃষ্টি হয় অবৈধ পথে ক্ষমতা পরিবর্তণের অনভিপ্রেত সুড়ঙ্গ।
কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ তার নিজের মতো সামনের বদলে পেছনে, কিংবা স্যেকুলারিজমের বদলে সাম্প্রদায়িকতার পথে হাঁটলে তাতে ভিনরাষ্ট্র হিসেবে ভারতের এত ভাবিত হবার কী আছে? আছে বৈকি। কারণ, প্রতিবেশী পরিবর্তন করা যায় না। প্রতিবেশী বিপথে ও বিশৃঙ্খলায় থাকলে তার প্রভাব থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যায় না। বাংলাদেশ ভারতের এমন একটি প্রতিবেশিদেশ যার জন্মের পেছনে ধাত্রী হিসেবে যেমন তার নিজের অবদান আছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের তিনদিক ঘিরে ভারতের সীমান্ত বেষ্টিত আছে। ভৌগোলিক এ অবস্থান বিচারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ভারতের নিজের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ অবস্থানে অবস্থিত বাংলাদেশ। রাষ্ট্র হিসেবে এটি এই অঞ্চলের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে সামনে রেখে ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশিদেশগুলোর সাথে যথাযথ সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্ব বহন করে। সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে সুবিদিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নয়া সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট চীন পরস্পর বিপরীতমুখী সত্ত্বেও দু পক্ষের কেউ কোনভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কলকাঠি নাড়ার কারিগর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারলে সেটা ভারতের জন্য ভবিষ্যৎ হুমকি হিসেবে আশংকা বজায় রাখবে। যদিও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে আমেরিকার ভূমিকা বরাবর চীনের বিপরীতে বিধায় কমবেশি ভারতের স্বার্থের অনুকূলেই কার্যকর থেকেছে। কিন্তু অধুনা বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আমেরিকা যেভাবে বর্তমান সরকার দল আওয়ামী লীগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এবং তাতে করে আওয়ামী লীগকে শত্রুর শত্রু চীনকে মিত্র হিসেবে স্থান করে দিতে হচ্ছে- এটা অবশ্যম্ভাবীভাবে ভারতের স্বার্থের প্রতিকূলে যাবে- এটাই বাস্তবতা।
এরিমধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়াবাড়ি রকমের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে চীন যে সুরে হুশিয়ারি দিয়েছে সেটা শুধু একটি নেহায়েত খেলার মাঠ নয় এতদাঞ্চলের অভাবিত কোনও বিশ্বযুদ্ধের সূচনা মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। যা একইসাথে বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তা শঙ্কা এবং ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ণের পাশাপাশি আসন্ন আন্তর্জাতিক অশনি সংকেতকেও নির্দেশ করছে। আর এসমস্ত কারণেই বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত এতদিন নীরব নিরপেক্ষ অবস্থানে আসীন থাকা সত্ত্বেও, এবং এ লক্ষ্যে ‘ভারত আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেন-দরবার করবে না’ এমন ঘোষণা সত্ত্বেও ভারত এই ইস্যুতে সক্রিয় অবস্থান নিতে যাচ্ছে।
আমেরিকার ক্রমবর্ধমান চাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের কাছে অনানুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জবাবে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের দফতর থেকে জানানো হয়েছে, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনের গুরুত্বের দিকটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন ওয়াশিংটন সফরে তুলে ধরা হবে। অবস্থা দৃষ্টে ধারণা করা হচ্ছে ভারতের সেই সফরে আমেরিকাকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে সামনে রেখে অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বার্তাই দেয়া হবে। সেই বার্তায় ভারত-প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির আশংকার কথা যেমন থাকবে, সেই সাথে উন্নয়নের মহাসড়কে গড়েওঠা প্রতিবেশি থেকে ছিটকে বাংলাদেশের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের খপ্পরে পড়ে যাবার আশংকাও তুলে ধরা হবে। স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে সন্ত্রাসী শাসকচক্র কখনো সুপ্রতিবেশি যেমন হয়না তেমনি সে দেশের জনকল্যাণেও কাজ করে না।
৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে, বাংলাদেশে যে অপশক্তি আজ গণতন্ত্রের জন্য চিৎকার চেঁচামেচিতে মাঠে নামছে তারা কি গণতন্ত্র চায়? নাকি একটি অছিলা তুলে চলমান গণতান্ত্রিক ও উন্নয়ন ধারাকে স্তব্ধ করে একটি উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সুযোগ থেকে জাতি ও রাষ্ট্রকে হটিয়ে আবার দুর্ভিক্ষপীড়িত তলাবিহীন ঝুড়ির একটি অকার্যকর বাংলাদেশ বানাতে চায়? এবিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা। আর সে পথে সুপ্রতিবেশি যে কোন রাষ্ট্রের সহায়তা ও পরামর্শ অবশ্যই আমাদের জন্য সহায়ক হবে- এটাই প্রত্যাশা।