বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন সমীকরণ
ব্রিকস ২০১০ সালে জন্ম নেয়া একটি বৈশ্বিক সংগঠন যার সদস্য দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা। ব্রিকস মূলত একটি অর্থনৈতিক সংগঠন যেটি আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালে বিশ্বের ২৬তম অর্থনীতির দেশ হবে। ২০৪১ হবে ১৬তম সমৃদ্ধশালী দেশ। দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নের রোল মডেল খ্যাতি অর্জনসহ উন্নয়নশীল দেশে পদার্পন করছে। বাংলাদেশের এ বিপুল অর্জন বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিবেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার। সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপের প্রেক্ষিতে এই ব্রিকস নামক সংগঠনের বিষয়টি আমাদের আলোচনায় এসছে।
বেশ গুঞ্জন চলছিল বাংলাদেশ কি তার চিরায়ত নিরপেক্ষ কুটনৈতিক সম্পর্কের ধারবাহিকতা বজায় রেখে পশ্চিমা আধিপত্যবাদী থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে কিনা। অন্যদিকে জোট পক্ষভূক্ত হলে সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়- এ নীতির আক্ষরিক অর্থে অস্তিত্ব থাকবে কি না। কিন্তু উপায় কি বলুন, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও উন্নয়ন অগ্রগতিকে চলমান রাখতে শেখ হাসিনা সরকারের নিকট এ মুহূর্তে বৈশ্বিক কোন ইতিবাচক জোটের সাথে যাওয়ার কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয়না। এসব গুঞ্জন ও আলোচনার সাথে সাম্প্রতিক ব্রিক্স এর আসন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশকে দেয়া আমন্ত্রণ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে আসলে কি হাসিনা সরকার ব্রিক্সের সাথে জোট বাধছে?
বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রথম সারির উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। বাংলাদেশ লাভ করেছে উন্নয়নশীল দেশের অকল্পণীয় মর্যাদা। মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছুই ছুই। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট, স্বপ্নের পদ্মা সেতু, কর্নফুলি নদীর তলদেশে টানেল, পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতার বাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, মেট্রোরেলের আবির্ভাব, রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্র ইত্যাদি আমাদের অর্জন। এই অর্জনের জন্য প্রশংসা হাসিনা সরকারের সত্য। কিন্তু এগুলোর জন্য কার গর্ব ভেবে দেখেছেন। এ অর্জন সতেরো কোটি মানুষের গর্ব ও মর্যাদার।
একটু পেছনে ফেরা যাক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু লাখো মানুষের আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে বিজয়ীর বেশে ফিরলেন তাঁর স্বপ্নের বাংলদেশে । চারিদিকে শুধু নেই আর নেই। টাকা নেই, খাদ্য নেই, রাস্তা নেই, সেতু নেই, ব্যাংকে রিজার্ভ নেই, উপরন্তু ৩০ লক্ষ শহিদের স্বজন ও আড়াই লক্ষ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের করুণ আর্তনাদ। ১ কোটি উদ্বাস্তুর যেমন কিছু নেই- শুধু শূন্য ভিটা ও পোড়া মাটি। ঠিক তেমনই দেশের কিছু নেই , শুধু একটি বিধ্বস্ত ভূখন্ড। বঙ্গবন্ধু জনগণকে সাথে নিয়ে মাতৃভূমির পুণর্গঠনে মন দিলেন। চাইলেন সহায্য। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষেরা এগিয়ে এলেন। দুহাত ভরে সহায়তা শুরু করলেন্। তিনি তিল তিল করে গড়ে তুলতে লাগলেন দেশকে। ঈর্ষান্বিত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি- রাজাকার, আলবদর ও রাজনৈতিক দল জামাত ইসলাম সক্রিয় হয়ে উঠল। তাদের মদদ দিল ১৯৭১ এর পরাজিত মহাশক্তিধর আমেরিকা ও পাকিস্তান।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিকে নিধনের জন্য পরিচালিত গণহত্যায় পাকিস্তানী হানাদারদের সমর্থন করেছিল আমেরিকা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে স্তব্ধ করতে পাঠিয়েছিল সপ্তম নৌবহর। সেদিন পাশে দাড়িয়েছিল তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন আজকের রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও প্রতিবেশি ভারতসহ বিশ্বের সকল শান্তিকামী শক্তি। স্পষ্টতই সেদিন সাড়েসাত কোটি বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন ও মানবাধিকার রক্ষায় পাশে এগিয়ে এসেছিল গণতান্ত্রিক ও মানবিক বিশ্ব। পরাজিত হয়েছিল অশুভ ও তাবেদারী ফ্যাসিবাদী অগণতান্ত্রিক শক্তি পাকিস্তান ও তাদের দোসর আমেরিকা।
আরও পড়ুন- বন্ধুত্বের দাবিতে ভারত আবারও দাঁড়াক বাংলাদেশের পাশে
ম্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী সেই বিদেশি চক্র পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি মদদে নির্মমভাবে হত্যা করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। একটিই উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে নতুন করে একটি তাবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করা।একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পূর্বে আমেরিকা ১৯৭৪ সালে ভারত মহাসাগর থেকে খাদ্যভর্তি জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে এবং কৃত্রিম মন্বান্তর সৃষ্টি করে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। কুড়িগ্রামে এক গরিব মায়ের গায়ে মাছ ধরা জাল জড়িয়ে সেদিন সৃষ্টি করা হয় বিবস্ত্র বাসন্তী নাটকের। তৈরী করা হয় সরকার বিরোধী আবহ। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেক্ষাপট তৈরী করে সাংবিধানিক সরকার উৎখাতকে জায়েজ করার জন্য ছিল এত সব আয়োজন।
দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও উন্নয়ন অগ্রগতিকে চলমান রাখতে শেখ হাসিনা সরকারের নিকট এ মুহূর্তে বৈশ্বিক কোন ইতিবাচক জোটের সাথে যাওয়ার কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয়না। এসব গুঞ্জন ও আলোচনার সাথে সাম্প্রতিক ব্রিক্স এর আসন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশকে দেয়া আমন্ত্রণ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে আসলে কি হাসিনা সরকার ব্রিক্সের সাথে জোট বাধছে?
আজ দীর্ঘ ৪৯ বছর পর আবার ষড়যন্ত্র। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধূয়ো তুলে বাংলাদেশে নতুন একটি অপরাজনৈতিক খেলার আয়োজনের আলামত দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। স্বাধীনতার পর মাত্র ১৮ ডলার নিয়ে শুরু হয়েছিল সাড়ে সাতকোটি সন্তান কোলে নিয়ে একটি ধর্ষিতা রক্তস্নাত মায়ের পথচলা।একটু ঘুরে দাড়াতেই মায়ের বুকে করা হলো চরম আঘাৎ। হত্যা করা হলো জাতির পিতাকে। স্তব্ধ হলো গণতন্ত্র। শাসনভার চলে গেল অগণতান্ত্রিক স্বৈর ও সামরিক শাসকের হাতে। তারপর টানা ২১ বছর স্বাধীন এ দেশকে স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে করা হলো পিষ্ট। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে অসংখ্য অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও জীবনের বিনিময়ে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে গণঅন্দোলনের ফসল হিসেবে পতন হলো স্বৈরশাসকের। আজও ঢাকার নূর হোসেন চত্তর মনে করিয়ে দেয়- খালি গায়ে বুকে পিঠে লেখা প্রতিবাদ “স্বৈরচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”। অত:পর স্বৈর শাসকের বুলেট ঝাজরা করে দিল নূর হোসেনের প্রতিবাদী ভাষা চিহ্নিত বুক। বইল রক্তের ধারা। রাজপথ হলো রঞ্জিত। দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। ১৯৪৭ এর পর থেকে বাঙালিরা তাদের ন্যায়সংগত ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে অসংখ্যবার রক্ত দিয়েছে। ধারণা ছিলো স্বাধীনতা লাভের পর আর রক্ত নয়, সুখী সমৃদ্ধ এক সাম্যবাদী সমাজ ও উন্নত দেশ গড়া হবে। সে কি আর হলো! জন্মলগ্ন থেকে ষড়যন্ত্র, হানা-হানি, সন্ত্রাস, সামরিক ক্যু, গণতন্ত্র হননকারী স্বৈর শাসন সবই বহাল তবিয়তে চলমান। এসবের মাঝে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারের বেশিদিন টিকে থাকার সুযোগে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার এক অনন্য নজির সৃষ্টি হলো । তিনি একটানা গত ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশকে দিলেন উন্নয়নের রোল মডেল খ্যাতি।
বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রথম সারির উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। বাংলাদেশ লাভ করেছে উন্নয়নশীল দেশের অকল্পণীয় মর্যাদা। মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছুই ছুই। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট, স্বপ্নের পদ্মা সেতু, কর্নফুলি নদীর তলদেশে টানেল, পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতার বাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, মেট্রোরেলের আবির্ভাব, রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্র ইত্যাদি আমাদের অর্জন। এই অর্জনের জন্য প্রশংসা হাসিনা সরকারের সত্য। কিন্তু এগুলোর জন্য কার গর্ব ভেবে দেখেছেন। এ অর্জন সতেরো কোটি মানুষের গর্ব ও মর্যাদার। আজ আর কেউ তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ বলে না। ফকির মিসকিনের বাংলাদেশ বলে উপহাস করে না। একটু ভাবুন, আজ সেই মর্যাদা ও গর্বকে চূর্ণ করে নতুন আধিপত্যবাদ, একই মদ বোতল পাল্টে ৪৯ বছর পর নতুন ব্রান্ড- হায় গণতন্ত্র, হায় গণতন্ত্র নাম দিয়ে বাংলাদেশের জন্য মায়া কান্নাসহ রূঢ়তর অনুশাসন ও থ্রেট নিয়ে হাজির হয়েছে আমেরিকা। বিশ্বের কোন দেশে যদি মানবাধিকার লংঘন ও অগণতান্ত্রিক কিছু ঘটে সে সব বিষয়গুলো দেখার জন্য প্রথম ধাপ নিজ দেশের সরকার, সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট ও রাজনৈতিক দল, সরোপরি জনগণ। বৈদেশিক পরিমন্ডলে ম্যান্ডেটেড কর্তপক্ষ জাতিসংঘ। এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন, তা হলে আমেরিকা এবং তার ক্রিড়ানক ইইউ কেন অকারণ ও অনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে? অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে, এটা নতুন উপনিবেশবাদ কায়েমের গোষ্ঠীগত কোন ষড়যন্ত্র যার মাধ্যমে সেই মধ্যযুগীয় স্বার্থবাদী আকাঙ্খা পূরণে তাদের এত লম্ফঝম্ফ।
ফিরে আসি ব্রিক্স প্রসংগে। ভূরাজনৈতিক কারনে পশ্চিমা বিশ্বসহ বৈশ্বিক নানামুখী চাপ দেশ ও জাতির উপর চেপে বসেছে। শত্রু চিহ্নিত। কয়লার ময়লা যেমন দূরীভূত হয়না তেমনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রকৃতি পরিবর্তণ হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা, ১৯৭১ এর নির্বিচার গণহত্যার সমর্থন, ১৯৭৪ সালে দেশে কৃত্রিম খাদ্যাভাব তৈরী, সর্বোপরি ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার নৃশংস হত্যার মধ্যদিয়ে সাংবিধানিক সরকারের উৎখাতে মদদ দানকারী যুক্তরাষ্ট্র কখনো বন্ধু ছিলো না, আজও নেই। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে তারা শত্রু এবং আজও সে ধারাবাহিকতা চলমান। এখন প্রয়োজন তাদের প্রতিরোধ করা। সে লক্ষ্যে অতীতের বন্ধু রাশিয়া ও ভারতসহ বর্তমান শক্তিশালী ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চীনা জোট ব্রিক্সে যোগদানকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ ইতিবাচক বলে মনে করছেন।
তবে এখানেও সাবধানতার প্রয়োজন রয়েছে। এ বিষয়ে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের প্রতি আমাদের অবিচল আস্থা রয়েছে। প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন শোষক ও অধিপত্যবাদীদের অত্যাচারে পিষ্ট এ জনপদ। আমরা অনাদিকাল থেকে ষড়যন্ত্র ও বঞ্চনার শিকার। আমরা সাম্রাজ্য বা স্ম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের স্বপ্ন যেমন দেখি না কারো রক্তচক্ষুর কাছে মাথাও নত করব না। দেশপ্রেমের জায়গা থেকে ১৭ কোটি মানুষকে সাথে নিয়ে সকল বাধা বিপত্তি রুখে বঙ্গবন্ধু কন্যা অবশ্যই এ জাতিকে আগলে রাখবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক- সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কেএইচ