সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের একটি সংবাদ সম্মেলনের পর উপসচিব পদে ক্যাডার অফিসারদের কোটা নিয়ে বেশ আলোচনা শোনা যাচ্ছে। বিদ্যমান বিধান অনুসারে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫% কর্মকর্তা ও অন্যান্য ক্যাডার থেকে ২৫% কর্মকর্তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সংস্কার কমিশন এই বণ্টনের বদলে ৫০%-৫০% এর সুপারিশ করতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়। এই খবরের পরেই ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে শুরু হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
অনেকেই হয়তো জানেন না যে, এই বিতর্কের বয়স বেশ পুরোনো যেটি শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। উচ্চ আদালতে ২০০১ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত আইনি লড়াই শেষে আপিল বিভাগ ২৪ মে ২০১০ সালে চূড়ান্ত আদেশে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৭৫% নিয়োগ প্রদান বৈধ ঘোষণা করে নির্দেশনা প্রদান করে। একই সাথে আপিল বিভাগ এই উপসংহারে পৌঁছায় যে, উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সহজাত অধিকার আছে এবং অন্য ক্যাডারের সহজাত অধিকার নাই। আপিল বিভাগের রায়ে আরো উল্লেখ করা হয় যে, উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫% নিয়োগ প্রদান সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদ, “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে”, এর লঙ্ঘন নয়। ২০১২ সালে প্রশাসন বাদে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা আপিল বিভাগের প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দায়ের করে যেটিও ২০১৬ সালে খারিজ হয়ে বিষয়টি উচ্চ আদালতে চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ আদালতের সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
কি ছিল সেই রায়ে? কোন কোন আইনি যুক্তিতে বিষয়টা মীমাংসিত হয়? পাবলিক স্পেসে এই বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে যে যুক্তিগুলো আমরা শুনতে পাচ্ছি তার অনেকগুলোই আসলে এই রায়ে খণ্ডন করা আছে এবং সে কারণেই এই বিতর্কের গভীরে যেতে হলে উচ্চ আদালতের এই রায় সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
মামলার শুরু
উপসচিব পদটি ঐতিহাসিকভাবেই প্রশাসন ক্যাডার ও তাদের পূর্বসুরি আইসিএস ও সিএসপিদের পদ। ১৯৭৭ সালে পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালে উপসচিব পদে নিয়োগের জন্য Senior Service Pool (SSP) Order, 1979 জারি করে সরকার যেখানে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (PSC) কর্তৃক পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পদে পুলে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। কমিশনের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে পিএসসির পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব পুল বা সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। পরে সিনিয়র সার্ভিস পুলের ধারণাটি অকার্যকর প্রমাণ হওয়ায় এটি রিভাইজ করার জন্য মোট দুটি কমিশন গঠন করা হয়। ১) Cabinet Subcommittee, 1987 এবং ২) Council Committee on Senior Appointment and Services Structure, 1987।
এসব কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৭ জুলাই ১৯৮৯ সালে সিনিয়র সার্ভিস পুল বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। জারি করা প্রজ্ঞাপনে উপসচিব ও যুগ্মসচিব পদে বিভিন্ন ক্যাডারের কোটা বণ্টন করা হয়। এই প্রজ্ঞাপনে মোট ৩৭৭টি উপসচিব পদের বিপরীতে প্রশাসন ও সচিবালয় ক্যাডার (এই দুই ক্যাডার পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে একীভূত হয়) এর জন্য মোট ৩০২টি পদ সংরক্ষণ করা হয় যা মোট পদের ৮০% এবং বলা হয় এই পদগুলো পরে এই ক্যাডারভুক্ত পদ বলে গণ্য হবে। এখান থেকেই মূলত উপসচিব পদে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন। এর পূর্ব থেকে উপসচিব পদটি মূলত প্রশাসন ক্যাডারেরই পদ হিসেবে প্রচলিত ছিল। ১৯৮৯ এর প্রজ্ঞাপনের ধারাবাহিকতায় প্রজ্ঞাপনে ৬ নং দফা অনুসরণ করে ১৯৯৮ সালে উপসচিব পদে নিয়োগ/পদোন্নতির নীতিমালার ‘ঙ’ দফায় সাবেক সচিবালয় ক্যাডারসহ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৭৫% বরাদ্দ রাখা হয় যেটি নিয়েই মূলত মামলার সূত্রপাত।
কেন মামলাগুলো করা হয়েছিল?
২০০১ সালে খাদ্য ক্যাডারের ৩ জন, তথ্য ক্যাডারের ১ জন ও কর ক্যাডারের ১ জন মোট ৫ জন মিলে হাইকোর্ট ডিভিশনে ৫টি রিট মামলা দায়ের করে (৩৯৩/২০০১, ৩৯৪/২০০১, ১৭০৭/২০০১, ১৭০৮/২০০১ ২২৩৭/২০০১)। রিট দায়েরকারীদের সংক্ষুব্ধতার অনুসন্ধানে তাদের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
১) যেহেতু খাদ্য, তথ্য ও কর ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সহিত একই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সেহেতু শুধুমাত্র প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের ‘সুযোগের সমতা’ এর লঙ্ঘন এবং ২৭ অনুচ্ছেদের ‘আইনের চোখে সমান’ এর লঙ্ঘন এবং সে কারণে বৈষম্যমূলক।
২) ১৯৯৮ সালে প্রণীত প্রজ্ঞাপনের আইনি ভিত্তি নেই (ফোর্স অব ল)।
[** এখানে বিশেষভাবে দেখার বিষয় যে, রিটকারীদের সবাই সাধারণ (জেনারেল) ক্যাডার। রিটকারীদের মধ্যে টেকনিক্যাল ক্যাডারের কেউ ছিলেন না কারণ টেকনিক্যাল ক্যাডার আর জেনারেল ক্যাডারের পরীক্ষা কিছুটা ভিন্ন।]
হাইকোর্টের রায় ও যুক্তি
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে হাইকোর্ট বিভাগ ১৯৯৮ এর প্রজ্ঞাপনকে সংবিধানের ২৯ ধারার লঙ্ঘন ঘোষণা দিয়ে রুল এবসোলিউট ঘোষণা করেন এবং প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫% উপসচিব পদায়ন অবৈধ ঘোষণা করেন। হাইকোর্ট বিভাগের প্রদত্ত রায়ের যুক্তিগুলো নিম্নরূপ-
১) বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা একই প্রক্রিয়ায় ও একই পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পান। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা অন্য ক্যাডারের সদস্যদের চেয়ে ভিন্ন নন এবং ক্যাডারভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসও ‘স্বেচ্ছামূলক’ বা ‘আরবিট্রারি’। ফলে, তাদেরকে ভিন্নভাবে ট্রিট করা হলে সাম্যের বিধান লঙ্ঘিত হয়।
২) একই সাথে আইন মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিসিএস (জুডিশিয়াল ক্যাডার, ২০০৭ এর পূর্বে বিধায়) ও বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের ক্ষেত্রে উপসচিব সমপর্যায়ের পদে কোটা বৈধ হবে কারণ তাদের কাজের ধরণ বিশেষ এবং তারা অন্যদের থেকে আলাদা। কেন প্রশাসন ক্যাডার অন্য ক্যাডার থেকে ভিন্ন তা প্রমাণিত হয়নি।
৩) প্রশাসন ক্যাডার ব্যতিরেকে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদন্নোতির সুযোগ দেওয়ার জন্য তাদের জন্য ২৫% কোটা রাখা হয়েছে- সরকার কর্তৃক এমন যুক্তিকে নাকচ করে হাইকোর্ট বিভাগ বলেন- এক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য বেশি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে এবং অন্যান্য ক্যাডারের জন্য কম সুযোগ দেওয়া হচ্ছে যা বৈষম্যমূলক।
আপিল বিভাগের রায় ও হাইকোর্ট প্রদত্ত যুক্তিখণ্ডন
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ সংক্ষুব্ধ হয়ে ১৫ এপ্রিল ২০০২ সালে ‘লিভ টু আপিল’ দায়ের করে এবং ২৭ জুলাই ২০০৩ তারিখে আপিল বিভাগ কর্তৃক অনুমতি প্রাপ্ত হয় (সিভিল আপিল – ২৯৪-২৯৮/২০০৩)। ১১ জুন ২০০২ তারিখে সরকারের উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত-সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা, ২০০২ এর ৫ এ ৭৫% এর বিধান বহাল রাখা হয়। ফলে, এই বিধিমালাও আপীলের বিচারের আওতায় আসে।
প্রায় ৭ বছর ধরে শুনানির পর আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের তিনটি যুক্তির সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করেন। অর্থাৎ, আপিল বিভাগের মতে, ১) পিএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও চয়েসের ভিত্তিতে যে ক্যাডারভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস করা হয় সেটি ‘আরবিট্রারি’ নয় বরং ‘রিজনেবল’ এবং এর ‘rational basis’ বা ভিত্তি নিকষ হয়েছে। ‘রিজনেবল’ ও ‘rational basis’ রয়েছে এমন দুটি শ্রেণিকে আলাদাভাবে ট্রিট করা ‘ডকট্রিন অফ ক্লাসিফিকেশন’ অনুযায়ী বৈধ।
২) প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব-সচিব পদে ঐতিহাসিকভাবে পলিসি প্রণয়নকারী রাজনীতিবিদ ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে সংযোগের কাজ করেন। ফলে, তাদের কাজের ধরনের সঙ্গে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের ভিন্নতা আছে।
৩) যেহেতু পিএসসি এর সুপারিশ পর্যায় হইতেই কমকর্তাগণ বিভিন্ন ক্যাডারে শ্রেণিভুক্ত হয়ে যান সেহেতু সচিবালয়ের উপসচিব পদে প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ ব্যতিত অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাগণের পুনরায় নিয়োগ বা পদন্নোতির কোন সহজাত অধিকার নেই।
রায়ের চুম্বক অংশ : কেন উপসচিব প্রশাসন ক্যাডারের সহজাত পদ?
আপিল বিভাগ তার রায়ে উল্লেখ করেন, ‘প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে একজন সচিব/অতিরিক্ত সচিব থাকেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের Principal Accounts কর্মকর্তা এবং প্রধান নির্বাহী। তাহার প্রধান কাজ মাঠ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করিয়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে যথাযথ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতঃ সিদ্ধান্ত লইতে (Policy Decision) সহায়তা করা। কর্মপন্থা নির্ধারণ হইলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হইতে সেই সিদ্ধান্ত কার্যে পরিণত করতে তত্ত্বাবধায়ন করার দায়িত্বও সচিবের উপর বর্তায়। এইরূপ কর্মপন্থা নির্ধারণ (Policy Decision) ও তাহা কার্যে পরিণত করিতে (Execution) সচিবের সহিত যুগ্ম-সচিব ও উপ-সচিব সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং তাহারা নির্বাহী সরকারের নির্বাহী অঙ্গ (Executive arm) হিসাবে পরিচিত। সাধারণ প্রশাসন কার্য ব্যতিরেকে মাঠ-পর্যায়ে সরকারের উপরোক্তভাবে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে বিভিন্ন পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হইতে বিভাগীয় কমিশনার পর্যন্ত সকল কর্মকর্তাগণের উপর। প্রকৃতপক্ষে মাঠ পর্যায় প্রশাসন এবং নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহিত উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিবগণ সেতুবন্ধের মতো কার্য করেন। এই কারণেই ব্রিটিশ আমল হইতেই সচিবালয়ের উপ-সচিব ও তদূর্ধ্ব পদে সব সময়ই প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ নিয়োগ ও পদোন্নতি পাইতেন। একমাত্র ব্যতিক্রম SSP Order এর মাধ্যমে সকল ক্যাডার হতে উপ-সচিব ও তদূর্ধ্ব পদে নিয়োগ/পদোন্নতি প্রদান করা হইয়াছিল যাহা ১৯৮৯ সনেই পরিত্যক্ত হইয়াছে। যেহেতু PSC এর সুপারিশ পর্যায় হইতেই কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন ক্যাডারে শ্রেণিভুক্ত হইয়া যায়, সেহেতু সচিবালয়ের প্রশাসনিক উপ-সচিব পদে প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ ব্যাতিরেকে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাগণের পুনরায় নিয়োগ বা পদোন্নতি প্রাপ্ত হইবার কোন সহজাত অধিকার নেই।’ [Civil Appeal No 294-98/2003, মামলার রায়ের পৃষ্ঠা ৭২, ৭৩।]
রায়ের চুম্বক অংশ : সুযোগের সমতা
এই মামলার অন্যতম বিচার্য বিষয় ছিল প্রশাসন ক্যাডার হতে উপসচিব পদে ৭৫% পদোন্নতি প্রদান সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ ১ ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে’ এর লঙ্ঘন। এই বিষয়ে আপিল বিভাগ সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগের সমতার বিষয়টি সম্পর্কে আমেরিকা, ভারত ও বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায় ও নজির বিশ্লেষণ করে সাম্যের মূলনীতি নিম্নরূপভাবে নির্ধারণ করেন।
ক) প্রজাতন্ত্রের পদে নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা থাকিবে, কোনরূপ বৈষম্য সাধারণভাবে অবৈধ
খ) এই সুযোগের সমতার অধিকার একই শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রযোজ্য
গ) reasonability ও যথাযুক্ত rational basis এর ভিত্তিতে শ্রেণিভুক্ত কর্মচারীদের প্রতি চাকরি বিধি সুযোগের সমতা সৃষ্টি করবে। আইনানুগভাবে যৌক্তিক ও rational basis এর ভিত্তিতে ভিন্ন শ্রেণিবিভক্ত এক শ্রেনীর অধিকার আর এক শ্রেণি নাও পেতে পারে।
‘‘প্রতীয়মান হয় যে শতাব্দীকাল পূর্ব হইতেই অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতবর্ষের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের সকল উচ্চতর পদে ICS and IPS ক্যাডার হইতে কর্মকর্তাগণ নিয়োগ ও পদোন্নতি পাইতেন। পাকিস্তান আমলেও প্রায় একই পদ্ধতি বিরাজমান ছিল। উচ্চতর পদের ২/৩ পদে CSP কর্মকর্তাগণ ও অবশিষ্ট ১/৩ পদে প্রাদেশিক প্রশাসনিক সার্ভিসের কর্মকর্তাগণ নিয়োগ/পদোন্নতি পাইতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হইবার পর সর্বপ্রথম ১৯৭৯ সালে Senior Service Pool (SSP) মারফত সকল সার্ভিস হইতে PSC মারফত পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব ও উর্ধ্বতন পদে নিয়োগ পদোন্নতির বিধান করা হইলেও কোনদিনই PSC মারফৎ নিয়োগ বা পদোন্নতি হয় নাই এবং SSP এর মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। ১৯৮৯ সালে SSP order বাতিল হয়। তৎপর প্রথমে ১৯৯৮ সালের নীতিমালা ও তৎপর ২০০২ সালের বিধিমালা মারফৎ উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে নিয়োগ পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সিংহভাগ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। নিয়োগ/পদোন্নতির এই পদ্ধতির বৈধতা রিট মোকদ্দমাগুলোতে চ্যালেঞ্জ করা হইয়াছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে PSC এর মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পরে সরকারের বিভিন্ন ক্যাডার সৃষ্টি করা হয় এবং ঐ ক্যাডারগুলোতে নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চাকরি বিধি Bangladesh Civil Service Recruitment Rules, 1981 প্রণয়ন করা হয়। উক্ত বিধিমালার ৩ ধারায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগের পদ্ধতি বর্ণনা করা হইয়াছে (……) এবং ৪ ধারায় সরাসরি নিয়োগের কথা বলা হইয়াছে। (….) ক্যাডারগুলোতে শূন্যপদগুলো নিয়োগের জন্য সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা, সর্বোচ্চ বয়স ইত্যাদি শার্তাদি বর্ণনা করত পিএসি আবেদনপ্রত্র আহ্বান করিয়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। প্রার্থীগণ এক বা একাধিক পদের তাহাদের পছন্দ (option) জ্ঞাপন করিয়া আবেদনপত্র দাখিল করে। তৎপর, PSC তাহাদের পদ্ধতি অনুসারে প্রার্থীগণের বিভিন্ন পরীক্ষা গ্রহণ করে।
সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ এর নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতার কথা বলা আছে। ক্যাডারগুলোতে শ্যন্য পদসমূহে নিয়োগের জন্য সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা, সর্বোচ্চ বয়স ইত্যাদি শর্তাদি বর্ণনা করত PSC আবেদনপত্র আহ্বান করিয়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। প্রার্থীরা এক বা একাধিক পদে তাহাদের পছন্দ জ্ঞাপন করিয়া আবেদনপত্র দাখিল করে। তৎপর, PSC তাহাদের পদ্ধতি অনুসারে প্রার্থীগণের বিভিন্ন পরীক্ষা গ্রহণ করে।
সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতার প্রশ্নটি এই পর্যায়ে আসে। এই অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুসারে PSC ইহার আইন ও বিধি সাপেক্ষে বাংলাদেশের সব নাগরিককে ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ নির্বেশেষে সকলকে PSC আয়োজিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ প্রদান করিতে বাধ্য। অতঃপর পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থীকে ২৯ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদ সাপেক্ষে প্রথমত মেধাক্রম অনুসারে এবং তৎপর প্রার্থীর নিজস্ব পছন্দের ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সরকারের নিকট PSC সুপারিশ করিবে।
উল্লেখ্য, যে সিভিল সার্ভিসের মোট ২৯টি ক্যাডারের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে বিসিএস (প্রশাসন) অবস্থিত অর্থাৎ যেসব প্রার্থী মেধা তালিকায় উপরের দিকে স্থান অধিকার করিয়াছেন এবং প্রশাসন ক্যাডারে যদি পছন্দ (option) জ্ঞাপন করিয়া থাকেন তাহা হইলে বিসিএস (প্রশাসন) এর শূন্য পদসমূহে তাহাদিগকে নিয়োগ প্রদানের জন্য PSC সুপারিশ করিবে। যে সকল প্রার্থী মেধা তালিকায় উচ্চতর স্থান প্রাপ্ত হইতে ব্যর্থ হইয়াছেন তাহারা তাহাদের পছন্দ (option) সাপেক্ষে পরবর্তী বা তৎপরবর্তী ক্রমান্বয়ে অবশিষ্ট ২৮টি ক্যাডারে নিয়োগের জন্য যোগ্য হইতে পারেন। এই ভাবে সকল প্রার্থীগণ PSC কর্তৃক অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হইবার সমান সুযোগ পান। তৎপর, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাহাদের নিজ নিজ ফলাফল ও পছন্দের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ প্রাপ্তির সমান সুযোগ পান। লক্ষণীয় যে যদিও সকল প্রার্থী একই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হইতেছেন কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল ও নিজ নিজ পছন্দের কারণে বিভিন্ন ক্যাডারে পৃথক শ্রেণিভুক্ত হইয়া যাইতেছেন। কিন্তু যেহেতু এই শ্রেণিভুক্তকরণ সার্বজনীন পরীক্ষা ও নিজ নিজ পছন্দের কারণে হইতেছে সেই হেতু উক্ত শ্রেণিভুক্তকরণ যৌক্তিক এবং ইহার যথাযুক্ত ভিওি-নিকষ (rational basis) রহিয়াছে যাহা সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ করে। হাইকোর্ট বিভাগ ইহার রায়ে উপরোক্ত প্রেক্ষাপট অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হইয়াছেন।’ [Civil Appeal No 294-98/2003, মামলার রায়ের পৃষ্ঠা ৬৯-৭১ পৃষ্ঠা)]
সুযোগের সমতা ও রিজনেবল ক্লাসিফিকেশন নিয়ে প্রাসঙ্গিক রায়ের উধ্বৃতি
এই দ্বন্দ্বের মূলে যেতে হলে সুযোগের সমতা ও ক্লাসিফিকেশন এর ধারণা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে বিষয়গুলোও আপিল বিভাগের রায়ে এসেছে। সুযোগের সমতা ও বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের উধ্বৃতি আপিল বিভাগ তার রায়ে নিয়ে আসেন যার মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু উধ্বৃতি হুবহু তুলে ধরা হলো।
“This equality of opportunity need not be confused with absolute equality . equality of opportunity of employment means equality as between members of the same class of employees and not equality between members of separate, independent class . (এই সুযোগের সমতাকে পরম সমতা হিসেবে নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। কর্মক্ষেত্রে সুযোগের সমতা বলতে বোঝায় একই শ্রেণিভুক্ত চাকরিজীবীদের মাঝে সুযোগের সমতা, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন শ্রেণিভুক্ত সদস্যদের মাঝের সমতা নয়।)”
“ Discrimination is the essence of classification. Equality is violated if it rests on unreasonable basis. The concept of equality has an inherent limitation arising from the very nature of the constitutional guarantee. Those who are similarly circumstanced are entitled to an equal treatment. Equality is amongst equals . Classification is, therefore, to be founded on substantial differences which distinguish persons grouped together from those left out of the groups and such differential attributes must bear a just and rational relation to the object sought to be achieved। (বৈষম্য হলো শ্রেণিকরণের মৌলিক চেতনা। সাম্য তখনই লঙ্ঘিত হয় যখন তা অযৌক্তিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্যের ধারণাগত দিক থেকেই একটি অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা আছে যা সংবিধিবদ্ধ নিশ্চয়তা হতে সৃষ্ট। সমধর্মী পরিস্থিতির আওতাধীন ব্যক্তিরাই মূলত সমান আচরণ প্রাপ্য। সমতা সমধর্মীদের মধ্যেই চর্চিত। সুতরাং, শ্রেণিবিভাগ বাস্তবিক পার্থক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি যা নির্দিষ্ট দলভুক্ত ব্যক্তিদের সাথে উক্ত দলের বাইরে থাকা থেকে একই শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিদেরকে আলাদা করে এবং এই ধরণের পার্থক্যমূলক বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনে প্রত্যাশীদের সাথে আবশ্যিকভাবেই ন্যায়সংগত এবং যৌক্তিক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে।)”
“A classification is reasonable if it include all persons who are similarly situated with respect to the purpose of the law. In other words, the classification must be founded on some reasonable ground which distinguishes persons who are grouped together and the ground of distinction must have rational relation to the object sought to be achieved by the rule or even the rules in question. It is a mistake to assume a priori that there can be no classification within a class, say, the lower division clerk”.( শ্রেণিবিন্যাস তখনই যৌক্তিক হয় যখন তা আইনের উদ্দেশ্যের আলোকে সমজাতীয় সকল ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এই শ্রেণিকরণ সেই যৌক্তিক ভিত্তিগুলোর উপর হতে হবে যেখানে সেই ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য করা হয় যারা একই শ্রেণিভুক্ত এবং এই পার্থক্যের ভিত্তি আবশ্যিকভাবে সেই উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত হবে যা রুলে বা বিধির মাধ্যমে খোঁজা হয় অথবা এমনকী যখন সেই রুল/ বিধি প্রশ্নের মুখে পরে তখনও। এটি তাত্ত্বিকভাবে ধরে নেওয়া ভুল যে একটি শ্রেণির মাঝে কোন শ্রেণিকরণ থাকবে না)।
সুযোগের সমতা মূলত একই সমানের মধ্যে সমতা। এক্ষেত্রে যারা একই পরীক্ষা দেয়নি এবং যাদেরকে মেধা ও চয়েসের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়েছে তাদেরকে সমান চোখে দেখার সুযোগ কম।
চূড়ান্ত রায়
উপরিল্লিখিত যুক্তিখণ্ডন শেষে আদালত নিম্নরূপ রায় দেন
আপিল বিভাগ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৩ ও ১০৪ এর আলোকে নিম্নলিখিত নির্দেশনা প্রদান করে-
ক) ১৯৯৮ সালের পূর্বতন নীতিমালা এর উপ-সচিব পদে পদোন্নতি/নিয়োগের নীতিমালার ‘ঙ’ দফা বৈধ ছিল।
খ) সরকারের উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত-সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা, ২০০২ এর ৫ দফা বৈধ
গ) ২০০২ সালের বিধিমালার প্রথম তফশিলের ১ম ক্রমিকে বর্ণিত উপ-সচিব পদে নিয়োগ পদ্ধতি বৈধ
ঘ) প্রথম তফশিলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্রমিকে বর্ণিত যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত-সচিব পদে কোটা আরোপ অবৈধ বিধায় উক্ত দুই পদে পদোন্নতির জন্য কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হইল।
আদালতের এই রায়ে এটি স্পষ্ট যে, উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫% নিয়োগ সুযোগের সমতার বিধানের লঙ্ঘন নয় এবং বৈষম্যমূলক নয়। এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ৫ম গ্রেডে শুধু উপসচিব পদেই পদোন্নতি পেয়ে থাকে, যেখানে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য দুটো সুযোগ উন্মুক্ত থাকে- ১) উপসচিব পদে, ২) তাদের ক্যাডারের নিজস্ব পদে। একটি ক্যাডারকে শুধু একটি সুযোগ দেওয়া আর অপর সকল ক্যাডারকে দুটো সুযোগ দেওয়াই বরং বৈষম্যমূলক। পাশাপাশি, স্পেশাল বিসিএস দিয়ে যারা ক্যাডার হন তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পান, ফলে হাইকোর্ট বিভাগের রিট উপস্থাপিত প্রথম যুক্তি সবার ‘একই রকম পরীক্ষা’ স্পেশাল বিসিএস ও টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য প্রযোজ্য নয় কারণ তারা জেনারেল ক্যাডারের সব পরীক্ষা দেন না এবং তাদের মেধাতালিকাও ভিন্ন ভিন্ন।
সব মিলিয়ে, সাম্যের পাঠ বোঝার জন্য আপিল বিভাগের এই রায়টি সবার জন্য সহায়ক হতে পারে। যেহেতু উচ্চ আদালত অনেক যুক্তিতর্ক শেষে বিষয়টি মীমাংসা করেছে সেহেতু সেই মীমাংসার পেছনের কারণগুলো আমাদের চিন্তাকে আরো সমৃদ্ধ করবে।
লেখক- সোহেল রানা ।। সিনিয়র সহকারী সচিব, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়