পর্দা উঠছে অমর একুশে বইমেলার
ভাষার মাসের প্রথম দিন শনিবার সেখানে পর্দা উঠছে অমর একুশে বইমেলার, যেখানে ভাষা শহীদ, ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের পাশাপাশি চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের শহীদদের প্রতিও শ্রদ্ধা আর স্মৃতি ধারণ করা হয়েছে।তুমুল গণআন্দোলনে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঠিক ছয় মাসের মাথায় দ্বার খুলছে বইমেলার।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবার সেজেছে লাল-কালো আর সাদা রঙে; ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিপ্লব, শোক আর আশার প্রদীপ। ভাষার মাসের প্রথম দিন শনিবার সেখানে পর্দা উঠছে অমর একুশে বইমেলার, যেখানে ভাষা শহীদ, ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের পাশাপাশি চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের শহীদদের প্রতিও শ্রদ্ধা আর স্মৃতি ধারণ করা হয়েছে।তুমুল গণআন্দোলনে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঠিক ছয় মাসের মাথায় দ্বার খুলছে বইমেলার। এবার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে শতাধিক, বেড়েছে আয়তনও। সেইসঙ্গে মেলার রঙ, প্রতিপাদ্য আর দৃশ্যপটেও এসেছে পরিবর্তন। আর গণআন্দোলনের স্মৃতি স্মরণে থাকছে ‘জুলাই চত্বর’।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার বিকালে বইমেলা উদ্বোধন করবেন। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ভাষার মাস জুড়ে চলবে মেলা।
শুক্রবার মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, স্টলগুলোর কাঠামো দাঁড়িয়ে গেলেও শেষ মুহূর্তে রঙ আর বইয়ের র্যাক তৈরিতে ব্যস্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। ভেসে আসছিল হাতুড়ি-পেরেকের ঠুকঠুক শব্দ।
মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশকদের দ্রুত কাজ শেষ করার তাগাদা দিলেও অনেক প্রকাশক এখনও কাজ শেষ করতে পারেননি। বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও দাপ্তরিক নানা কাজের পাশাপাশি ব্যস্ত বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সাজানো নিয়ে। প্রকাশকরা বলছেন, একদিকে বই ছাপানোর ব্যস্ততা, অন্যদিকে মেলার মাঠে স্টল গোছানোর কাজ। সব মিলিয়ে তাদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। কাঁটাবন, বাংলাবাজারের প্রেস থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কর্মীরা।
আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবারই মেলায় সপ্তাহ-দশদিন আগে প্রকাশকদের স্টল বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এবার ২২ তারিখ আমরা স্টল পেয়েছি। মেলার মাঠে ঘুরে দেখেছি অনেকেই কাজ শেষ করে ফেলেছেন। আশা করি প্রথম দিন থেকেই এবার মেলা জমে উঠবে।”
প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এবার ৫২টি বিষয়ের ওপর দুই শতাধিক বই প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ২৫ জন নতুন লেখকের প্রথম বইও রয়েছে।
প্রকাশনা ও বই বিপণন কেন্দ্র বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বলেন, “সব মিলিয়ে এবার ভালোই হবে বলে মনে করছি। আমাদের অধিকাংশ বই ছাপা হয়ে গেছে। ৬০টির মত নতুন বই আমরা এবারের মেলায় নিয়ে আসব। এর মধ্যে ২৫টিরও বেশি বই ছাপা সম্পন্ন হয়ে গেছে।”
বেড়েছে পরিসর
বই মেলার ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে বড় মেলা হতে যাচ্ছে বলে আয়োজক কর্তৃপক্ষ বলছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য-সচিব সরকার আমিন বলেন, “বলা যায় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বইমেলা হচ্ছে। শতাধিক নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবার মেলায় অংশ নিচ্ছে, আগে যারা অংশ নিয়েছেন তারাও আছেন। সবমিলিয়ে আয়তন ও অংশগ্রহণ বেড়েছে।”
এবারের বইমেলায় ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৮৪ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গতবছর প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি এবং ইউনিট ছিল ৯৪৬টি।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এবার মোট প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি, যার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে ৩৬টি। গত বছরও প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি ছিল।
লিটল ম্যাগাজিন চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায় করা হয়েছে। সেখানে ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া শিশু চত্বরে ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর শিশু চত্বরে ৬৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০৯ ইউনিট দেওয়া হয়েছিল।
বইমেলার প্রস্তুতি নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, “কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এ বছর আমরা কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। আমরা অসম্ভব পরিশ্রম করেছি, তবে এতে নানারকমের ত্রুটিবিচ্যুতি আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। সেগুলো মোকাবিলা করে আমাদের এ প্রস্তুতি নিতে পেরেছি।”
মেলার সূচি
প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার ও সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ৮ ফেব্রুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাড়া প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে।
অমর একুশ উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতা থাকছে। উদ্যানে থাকবে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।
১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
মেলার কোথায় কী
বাংলা একাডেমি বলছে, এবার সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া বইমেলার বিন্যাস গতবারের মতই রাখা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে মেলার বের হওয়ার পথ এবার একটু সরিয়ে মন্দির গেইটের কাছাকাছি নেওয়া হয়েছে। টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্ল্যান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে মোট চারটি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ থাকবে।
খাবারের স্টলগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের সীমানা ঘেঁষে রাখা হয়েছে। নামাজের স্থান, ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবাও থাকবে। মন্দির গেইটের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে শিশু চত্বর, যাতে শিশুরা অবাধে চলতে-ফিরতে পারে।
বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫% কমিশনে বই বিক্রি করবে। বাংলা একাডেমির তিনটি প্যাভিলিয়ন ও শিশুকিশোর উপযোগী প্রকাশনার জন্য একটি স্টল থাকবে।
এবারের বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ৪৩টি ও পুনর্মুদ্রিত ৪১টি বই।
বইমেলার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে আর্চওয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
‘জুলাই চত্বর’
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ধারণ করে শুরু হওয়া মেলায় ভাষা শহীদ ও ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে এবারের আয়োজনে।
আয়োজকরা বলছেন, এবারের মেলার রঙ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে লাল, কালো ও সাদা। বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে লাল, শোকের প্রতীক হিসেবে কালো এবং আশার প্রদীপ হিসেবে সাদা।
জুলাই-অগাস্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবারের বইমেলার প্রেক্ষাপটটাও ভিন্ন। গণআন্দোলন ফুটিয়ে তুলতে বইমেলায় থাকছে ‘জুলাই চত্বর’।
পুরস্কার
বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২৪ সাল থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০২৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।
এ ছাড়া ২০২৪ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।
ডিএমপির নির্দেশনা
বইমেলা ঘিরে বেশকিছু নির্দেশনা তুলে ধরেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বইমেলার কারণে বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় রাস্তা বন্ধ অথবা রোড ডাইভারশন দেওয়া হবে।
ডাইভারশন পয়েন্টের মধ্যে রয়েছে- টিএসসি/রাজু ভাস্কর্য ক্রসিং, তিন নেতার মাজার গ্যাপ, হাকিম চত্বর।
পার্কিং স্থান- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মুহসীন হল মাঠ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে, ফুলার রোডে (এক লেনে) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে।
শাহবাগ ক্রসিং থেকে টিএসসি হয়ে গাড়িযোগে মেলায় আগত দর্শনার্থীরা বইমেলার টিএসসি প্রবেশ গেইটের সামনে নামবেন এবং গাড়ি রাজু ভাস্কর্য ইউটার্ন-লেফটটার্ন করে বইমেলা সংশ্লিষ্ট পার্কিং স্থান অথবা গন্তব্যে যাবেন।
নীলক্ষেত/ভিসি বাংলো ক্রসিং হতে টিএসসি হয়ে গাড়িযোগে মেলায় আসা দর্শনার্থীরা হাকিম চত্বর নেমে পায়ে হেটে মেলায় প্রবেশ করবেন এবং গাড়ি হাকিম চত্বর ইউটার্ন-রাইটটার্ন করে বইমেলা সংশ্লিষ্ট পার্কিং স্থান অথবা গন্তব্যে যাবেন।
হাই কোর্ট ও শহিদুল্লাহ হল ক্রসিং হতে দোয়েল চত্বর ক্রসিং হয়ে বাংলা একাডেমি অভিমুখে গাড়িযোগে মেলার দর্শনার্থীরা তিন নেতার মাজার গ্যাপে নামবেন এবং গাড়ি ইউটার্ন করে বইমেলা সংশ্লিষ্ট পার্কিং স্থান অথবা গন্তব্যে যাবেন।
এএসএস