নিরাপদ পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর

প্রকল্পের খাত ভিত্তিক বিভিন্ন ব্যয়ের হিসাব ডিপিপি না দেখে বলতে পারব না। মন্ত্রণালয় থেকে আমরা প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। প্রকল্প যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনা কমিশন সংশোধনের জন্য ডিপিপি আমাদের কাছে পাঠালে আমরা ঠিক করে দেব।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানায়, খুলনা মহানগরীতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জন্য সারা বছর সুপেয় পানি সরবরাহ করতে খুলনা ওয়াসার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে খুলনা শহরে নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভূপৃষ্ঠের পানি সরবরাহের মাধ্যমে বিদ্যমান পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করতে ‘খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২)’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৮০৪ কোটি ৬৭ লাখ এবং ঋণ হিসেবে ১ হাজার ৮৫৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের পর প্রকল্পটি ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে খুলনা ওয়াসার বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে।
খুলনা ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খুলনা ওয়াসা বর্তমানে বিদ্যমান সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের উৎপাদিত পানি এবং নলকূপ থেকে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে গ্রাহকদের চাহিদার শতভাগ পূরণ করে। কিন্তু খুলনা অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে (এপ্রিল ও মে) জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এপ্রিল মাস থেকে মধুমতি নদীর পানিতে লবণাক্ততা দেখা দেয়। বর্তমানে খুলনা ওয়াসা মধুমতি নদী থেকে প্রায় ১০ মাস নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে পারে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে স্বাভাবিক নিরাপদ পানি সরবরাহ বছরের ২ মাস (এপ্রিল ও মে) ব্যাহত হয়। যখন গ্রহণযোগ্য লবণাক্ততার সীমা প্রতি লিটারে ৬০০ মিলিগ্রাম থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৬০০ হয় তখন খুলনাবাসীকে কাঙ্ক্ষিত মানের পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। নদীর পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে ভবিষ্যতে শুষ্ক মৌসুম দীর্ঘায়ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, খুলনা মহানগরীতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জন্য সারা বছর সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্যে খুলনা ওয়াসা থেকে ‘খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২)’ প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মাধ্যমে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান সরবরাহ বহির্ভূত এলাকা এবং বর্ধিত এলাকায় পাইপলাইন স্থাপন, বিতরণ, রিজার্ভার ও উচ্চ জলাধার নির্মাণ, পানি ধরে রাখার জন্য ইম্পাউন্ডিং রিজার্ভার নির্মাণ, ধারণক্ষমতা উন্নতিকরণ, বর্তমান পানি শোধনাগার এবং ইনটেকের সক্ষমতা বর্ধিতকরণ, পরিশোধিত পানির সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া খুলনা ওয়াসার উৎপাদক কূপগুলো ১৫ থেকে ২০ বছরেরও বেশি আগে স্থাপন করা হয়, যার অধিকাংশ ফিল্টার এবং ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল সরঞ্জাম দীর্ঘ সময়ের কারণে কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। এ উৎপাদক কূপগুলোকে প্রতিস্থাপন করার সংস্থান এ প্রকল্পে রাখা হয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্যে যা বলা হয়েছে— ক. শুষ্ক মৌসুমে খুলনা শহরে নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভূপৃষ্ঠের পানি সরবরাহের মাধ্যমে বিদ্যমান পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করা এবং যেসব এলাকায় পাইপযুক্ত পানি সরবরাহ নেই সেসব এলাকায় পানি সরবরাহের কভারেজ সম্প্রসারণ করা।
খ. খুলনা সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যমান এলাকা এবং সম্প্রসারণ এলাকায় পাইপলাইন পানি সরবরাহ পরিষেবা সম্প্রসারণ করা।
গ. সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট এবং সারফেস ওয়াটার রিজার্ভারের ক্ষমতা বাড়ানো।
ঘ. ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে খুলনা শহরে শুষ্ক মৌসুমে পরিপূর্ণ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা।
ঙ. সারাবছর ধরে গুণগত মান সম্পন্ন পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বিকাশ করা।
চ. আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং স্মার্ট মনিটরিং সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে পানি সরবরাহ উন্নত করা।
ছ. বিদ্যুৎ খরচ কমাতে এবং পরিবেশগত উন্নতির জন্য গ্রিড সোলার পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম (গ্রিন এনার্জি১) স্থাপন করা।
জ. আধুনিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য খুলনা ওয়াসার কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় উপস্থাপন করা হয়। এ কমিটি প্রকল্প যাচাই ও মূল্যায়ন করে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি ও পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। সেগুলো হলো—
ক. কনভেন্স এক্সপেন্ডিচার ১.২০ কোটি টাকা, জ্বালানি খরচ ৯০ লাখ টাকা, সেমিনার কনফারেন্স বাবদ ২৫ লাখ টাকা এবং ১০টি ডেক্সটপ, ৪টি ল্যাপটপ, ১০টি স্ক্যানার, ৪টি ফটোকপিয়ারের সংখ্যা ও মূল্য অধিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
খ. ১০টি মোটরসাইকেল ক্রয়ের প্রয়োজনীয়তা সভায় আলোচনা করা হয়েছে। মোটরসাইকেলের মূল্য অর্থ বিভাগের পরিপত্র অনুসারে নির্ধারণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
গ. পরামর্শক ব্যয়ের মধ্যে দেশি-বিদেশি পরামর্শক ব্যয় বাবদ ৮৪ কোটি ৭ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। কিন্তু পরামর্শক সেবার বিস্তারিত ব্যয় বিভাজন নেই। পরামর্শক ব্যয় অধিক মর্মে প্রতীয়মান হয়।
ঘ. উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনায় (ডিপিপি) বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে যেসব আইটেমে রেট শিডিউল অনুসরণ করা সম্ভব রেট শিডিউলের আলোকে সেসব অঙ্গের ব্যয় প্রাক্কলন প্রণয়ন এবং যেসব ক্ষেত্রে রেট শিডিউল নেই সেক্ষেত্রে বাজার দর যাচাই করে একটি ব্যয় প্রাক্কলন কমিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অঙ্গের ব্যয় প্রাক্কলন করে কমিটির সদস্যদের নামসহ সিল ও স্বাক্ষর দিয়ে তা ডিপিপিতে সংযুক্ত করা সমীচীন।
ঙ. ২৫৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের জন্য ২৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিপিপিতে মৌজা রেট সংযুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন মৌজায় কত দরে কত শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হবে তার একটি সারসংক্ষেপ ডিপিপিতে থাকা বাঞ্ছনীয়।
চ. প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের শাখা কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সভাপতি ও খুলনা ওয়াসার পরিকল্পনা শাখা থেকে সদস্য সচিব রাখা বাঞ্ছনীয়।
এ বিষয়ে জানতে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান মো. হায়দর আলীকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
প্রকল্প প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুলনা অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট আছে। খুলনা ওয়াসার মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে খুলনা সিটি কর্পোরেশন, রূপসা ও মোল্লাহাট উপজেলায় সুপেয় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। কারণ এ অঞ্চলে বছরে দুই মাস নিরাপদ পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এ দুই মাসে এসব অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যায়। যার ফলে এসময়ে এখানে নিরাপদ পানির সংকট দেখা দেয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পের খাত ভিত্তিক বিভিন্ন ব্যয়ের হিসাব ডিপিপি না দেখে বলতে পারব না। মন্ত্রণালয় থেকে আমরা প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। প্রকল্প যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনা কমিশন সংশোধনের জন্য ডিপিপি আমাদের কাছে পাঠালে আমরা ঠিক করে দেব। পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ডিপিপি সংশোধন করার পরই চূড়ান্ত অনুমোদন হবে।
এএসএস