ডিআইইউ প্রতিবেদক,
দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। তার লেখা এতোটাই জনপ্রিয় যে, তরুণ তরুণীরাদের মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে লেখাগুলো।
মোঃ সিদরাতুল মুনতাহা রাকিন
অর্থনীতি বিভাগ,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী প্রিয় লেখকে ব্যস্ততার মধ্যে শুভেচ্ছা জানাতে ভুল করেননি
শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার স্যার !
আপনি কেমন আছেন? ওপারে নিশ্চয়ই ভালোই আছেন। আপনার ঈশ্বর নিশ্চয়ই আপনাকে ভালো রেখেছেন।
আপনাকে নিয়ে বলার কিছু নেই, বলার প্রয়োজনও পড়ে না। জীবনে একবার ভুল করে আপনার লেখা একটি বই "গর্ভধারিণী" পড়ে ফেলেছিলাম! তারপর থেকে আর নিজেকে আটকাতে পারি নি। আপনার সৃষ্টি আমাকে বইয়ের পাতায় আটকে রেখেছে, মুক্তি দেয় নি।
আজ পর্যন্ত আপনার লেখা ১৮ টি বই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। শুরুটা "গর্ভধারিণী" দিয়ে, এরপর একে একে— "কথা হয়ে গেছে", "এই আমি রেনু", "মেয়েরা যেমন হয়", "জনযাজক", "সাতকাহন", "আমাকে চাই", "কেউ কেউ একা", "কেউ বোঝে না", "ভালো থেকো ভালোবাসা", "মনের মতো মন", "অনেকেই একা", "উজাড়", "একাকিনী", "উনকি", "উত্তরাধিকার", "কালবেলা", "কালপুরুষ"।
পরীক্ষার জন্য "মৌষলকাল" পড়া হয়নি, কিন্তু কিনে রেখেছি আরও বেশ কয়েকটি বই— "জলের নিচে প্রথম প্রেম", "প্রিয় আমার", "আলোক রেখা", "কোথায় যাবে সে", "আট কুটুরি নয় দরজা", "হিরে বসানো সোনার ফুল", "অসুখলতার ফুল", "দায় বন্ধন", "সমরেশের সেরা ১০১"। এগুলো পড়ার অপেক্ষায় রেখেছি।
এই দুই বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যতটুকু সময় পেয়েছি, তার বেশিরভাগই আপনার বইয়ের পাতায় ডুবে থেকেছি। আপনার লেখা পড়লে মনে হয়, এক জীবনে কখনো সব সমস্যার সমাধান হয় না, কিন্তু চাইলেই অনেক সমস্যা সমাধান করা যায় এবং অসম্ভব সুন্দর ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা যায়। আপনার লেখনীতে শৈশব থেকে শুরু করে নিয়ে বার্ধক্যে যাওয়ার সময়কালের জীবনী পড়া যায়। আপনার লেখা আমাকে শিখিয়েছে, সত্যিকারের জীবন কেমন হওয়া উচিত, কেমন হতে পারত!
দুই বছর আগে আপনাকে চিনতাম না। আপনার লেখা পড়তেও তেমন আগ্রহ ছিল না। অথচ আজ, দুই বছর পর, আপনার বই ছাড়া অন্য কোনো বই পড়তে ভালো লাগে না। মনে হয়, পৃথিবীর এক জীবন ভালোবাসার জন্য আর বই পড়ার জন্য বড়ই ক্ষুদ্র!
"উত্তরাধিকার", "কালবেলা", "কালপুরুষ", "গর্ভধারিণী", "সাতকাহন"—এই বইগুলোর গভীরতা মাপার মতো শব্দ আমি এখনও খুঁজে পাইনি। ভাবতে অবাক লাগে, "কালবেলা" একসময় দুই লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। এখন সংখ্যাটা কত, কে জানে!
আপনার বই পড়ে পাঠকের চোখে জল এসেছে,কেউ কেউ হয়তো আপনার লিখাকে পড়ে জীবনের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছে। আপনি আমাদের জীবনে নিতান্তই প্রিয় একজন,যাকে ছাড়া আমরা হয়তো জীবনের ছোট্ট একটা অংশ অসম্পূর্ণ থেকে যেত । আপনার এক জীবনে অজস্র পাঠক আপনার বই পড়ে কেঁদেছে,অঝোরে কেঁদেছে। অনেককে কাঁদিয়ে ও,আপনি অনেকের প্রিয় লেখক! তার মধ্যে আমি ও ক্ষুদ্র একজন !
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিন আরো বলেন
অঞ্জন দত্ত, উনার ইন্টারভিউতে সমরেশ মজুমদার স্যারকে একটি প্রশ্ন করেছিলেন ,"আপনার আপনি রেখে যাচ্ছেন তো আপনার আমাদের পরের প্রজন্ম বলুন,সন্তান , সেখানে একটা বই আপনি আপনাদের মাঝে বলতে পারবেন,যেটা এই টেবিলটার মতো আমি এই বইটা রেখে গেলাম ?"
তিনি উত্তরে বলেছিলেন "আমি যখন মারা যাবো আমি যখন থাকবো না,
আমি জানি যতদিন মানুষের বুকে আবেগ থাকবে ,আবেগ যতদিন থাকবে ততদিন মানুষ মানুষ থাকবে । ততদিন একটি বই আমার লেখা, আমি খুব সামান্য একজন লেখক,তবু একটি বই বেঁচে থাকবে । কতদিন বেঁচে থাকবে কালজয়ী হয়ে , আমি জানি না । বইটির নাম "উত্তরাধিকার"। পাতা উল্টে পড়তে গিয়ে বুকের মধ্যে একটা দংকা বাতাস ওঠে ,কাঁপুনি আসে । এই যে আমারই আসে,যেই আমি আমার নিজেরই কোন লেখাই পড়তে চাই না !
তিনি আরো বলেন
আমার প্রথম লেখা যে টাকাটি পেয়েছিলাম,
(দেশ পত্রিকায় প্রথম গল্প 'অন্তর আত্মা' প্রকাশিত হয়
১৯৬৭ সালে, ৩০শে সেপ্টেম্বর।)
কফি খেয়ে শেষ করেছিলাম। বন্ধুরা বললো লেখ আবার টাকা পাবি তাহলে আবার কফি খেতে পারব । আমি বিশ্বাস করি আমি যদি না খেয়ে, পরিবারের চিকিৎসার জোগাড় করতে না পেরে, শুধু ভালো ভালো লিখা লিখে যাই । সৎ হয়ে লিখে যাই । আপনারা কি খুশি হবেন ?
আপনারা রাতে ঘুমাতে পারবেন ? পারবেন না জানি । তাই যখন বলি টাকার জন্য লিখি, তখন একটু বেশিই বলি। কিন্তু বলাটার মধ্যে মিথ্যা থাকেনা । তাই না ? কী বলো তুমি ?
তারপরে আর কোন কথা হয় নি সেই ইন্টারভিউতে !
আরেকটি ইন্টারভিউতে তিনি একটি কবিতা আবৃত্তি করেন
"কেউ কেউ খুব একা
আকাশের মত একা
এক বুক মেঘ নিয়েও
জলের পায় না দেখা ।
ভরদুপুরে সাহারার বুকে
ফুটে যদি কোন ফুল ,
যেন সে তো তারই ভুল ।
করুণা করে না দপ্ত ওলকা
সে যেনো থাকবে একা ,
ভরা পূর্ণিমা জ্যোৎস্না সাজায় তারার দেওয়ারি জেলে
জোছনার হোলি খেলে ।
গর্বিত চাঁদ নতোমুখি হলে
সূর্য পড়ায় টিকা
কেউ কেউ খুব একা
আকাশের মত একা !
"আপনার মনে হয় আপনি একা ?"
"আমার তো মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একা " ।
আপনার আরও কিছু অমর উক্তি না দিলেই নয়—
আঘাত কি আমি জানি, তাই সেটা কাউকে দিতে একদম ইচ্ছে করে না!
মানুষ সব সময় প্রিয় জনকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু একা একা থাকতে থাকতে একটা সময় আসে, যখন অন্য লোকের ছায়াও সহ্য হয় না।
আজ এত বছর পরে সেই তারাটাকে খুঁজতে গিয়ে হাসি পেল অনিমেষের। হায়, তাদেরও বয়স বাড়ে, তারারাও মরে যায়।
"ভবানী মাস্টার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বললেন, 'একটা কথা মনে রাখবা, বাবা, নিজের কাছে সৎ থাকলে জীবনে কোন দুঃখই দুঃখ হয় না। তুমি অনেক বড় হবা একদিন, কিন্তু সৎ থাকবা, আমাকে কথা দাও!'
কথাগুলো শুনতে শুনতে অনি আবার কেঁদে ফেলল।
অনিমেষের মনে হল, অনেক অনেক বছর আগের সে এখনকার তাকে দুচোখ ভরে দেখছে। সেই বালক বলছে, 'কেমন আছ অনিমেষ?'
এই মধ্যবয়স জবাব দিচ্ছে, 'ভাল না, একদম ভাল না।'
'তোমার তো এমন হবার কথা ছিল না।'
'আমি যখন তুমি ছিলাম, তখন ছিল না। তোমাকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি যখন তুমি ছিলাম, তখন সত্যিই ভাল ছিলাম।'"
এক ফোঁটা ভালোবাসার জন্য যদি কোন মানুষ লক্ষ মাইল হেঁটে যেতে পারে, তাহলে একটা পুরো সমুদ্র পেলে সে কি করবে?
কে বেশি নিষ্ঠুর? মানুষ নাকি প্রকৃতি?
আমরা কাউকে অকারণে মনে রেখে দিই চিরকাল, যাকে হয়তো আমাদের মনে রাখার কোনো কথাই নেই!
কে যে কাকে ভালোবাসে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন!
তোরা সবাই হলি পাখির মতো। ডানায় জোর এলেই উড়ে যাস। এই যে তুই, আমার মেয়ের নাতি, তোকে দেখে যে কী ভাল লাগছে! তুইও পাখি হয়ে যাবি। বড়মা অমৃতর গায়ে হাত রাখলেন। হাতের চামড়ায় অজস্র ভাঁজ, ঝুলে গেছে।
আমি টাকা জমাচ্ছি। সেদিন, যখন অনেক টাকা হবে, সময় কেনার মতো টাকা, সেদিন কিছু সময় কিনে নেবো। যারা প্রতি দিন, প্রতি মাস, প্রতি বছরে বলে যায়– ‘খুব ব্যস্ত, একদম সময় পাই না, কাজের চাপে মনে থাকে না’, তাদের সে কেনা সময় ধার দেব। সময় কেনা হয়ে গেলে, আমি আবার টাকা জমাবো। এরপর কিনবো ‘অজুহাত’। পৃথিবীর সমস্ত অজুহাত কিনে জমাবো। সময়ের অভাবে, অজুহাতের কারণে, কেউ যেন আর প্রিয় মানুষদের ভুলে না যায়– তাই অফুরন্ত সময় আর শূন্য অজুহাতের এক পৃথিবী বানাবো।
ফিরে আসছিলাম। তখন এখানে অনেক প্রজাপতি উড়ছিল। মেঘ ভাঙা ভাঙা রোদ ঝরে ঝরে পড়ছিল, নদী বয়ে যাচ্ছিল গর্বিত হয়ে, আকাশের নীল মেখে। শুধু তুমি নেই। কোথাও তুমি নেই। তাই কেউ এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করছে না, ‘ভালোবাসা কাকে বলে?’
কিন্তু আমি এই হৃদয় নিংড়ে উচ্চারণ করেছি নীরবে, যেখানেই থাকো, ভালো থেকো, ভালোবাসা। - সমরেশ মজুমদার
সবকিছু মিলিয়ে উপলব্ধি করতে পারলাম হয়তো বা জীবনে আপনিও কাউকে ভালোবেসে ছিলেন। অসম্ভব ভালোবেসে ছিলেন । তবে তিনি ও কী আপনাকে ভালোবেসে ছিলেন? আপনাদের পরিচয় কোথায় হয়েছিল? আপনিও কী কখনো তাকে পাওয়ার জন্য অঝোরে কেঁদেছিলেন? কতকিছুই তো অজানা থেকে গেল প্রিয় লেখক ! আপনি যদি আজ প্রত্যক্ষভাবে জীবিত থাকতেন তবে হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর পেতাম! অবশেষে এতোটুকু বলতে চাই ,
আপনি বলেছিলেন "আমরা কাউকে অকারণে মনে রেখে দিই চিরকাল, যাকে হয়তো আমাদের মনে রাখার কোনো কথাই নেই!" আপনার এই বাক্য ও আপনার লিখা আমার মনে থাকবে চিরকাল ।
শুভ জন্মদিন, সমরেশ মজুমদার স্যার!